দেশের দক্ষিণাঞ্চলের ২১ জেলার মানুষের যোগাযোগের সহজ মাধ্যম লক্ষ্মীপুরের মজুচৌধুরীরহাট থেকে ভোলা-বরিশাল নৌ-রুট। এ রুট দিয়ে প্রতিদিন চারটি ফেরি ও ৮-১০টি লঞ্চ চলাচল করে। তবে লক্ষ্মীপুর থেকে ভোলা পর্যন্ত প্রায় ২৮ কিলোমিটার নৌপথে জেগে ওঠা ডুবোচরের কারণে ব্যাহত হচ্ছে নৌযান চলাচল। নাব্য সংকটের কারণে গন্তব্যে যেতে হয় সাত-আট কিলোমিটার ঘুরে। এতে ৩ ঘণ্টার পথে সময় লাগছে ৫-৬ ঘণ্টা। যাত্রীবাহী লঞ্চগুলোকে আবার চলতে হয় বাঁশের খুঁটিতে পানির উচ্চতা পরিমাপ করে এবং ফেরিকে নির্ভর করতে হয় জোয়ারের ওপর। ফলে ফেরিঘাটে অপেক্ষায় থাকতে হচ্ছে শতাধিক পণ্যবাহী যানবাহনকে।
স্থানীয়রা জানান, ঢাকা-চট্টগ্রামের সঙ্গে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের যাতায়াতের সুবিধার্থে ২০০৮ সালে লক্ষ্মীপুরের মজুচৌধুরীরহাট ফেরিঘাট সার্ভিস চালু করে সরকার। কিন্তু নাব্য সংকটের কারণে লক্ষ্মীপুর-ভোলা নৌ-রুটে চলাচল করা ফেরিগুলোকে নির্ভর করতে হয় জোয়ার-ভাটার ওপর। এতে সময় নষ্ট হওয়ার পাশাপশি প্রতিদিন ফেরি ও লঞ্চ ডুবোচরে আটকা পড়ে। এতে চরম দুর্ভোগে পড়তে হচ্ছে এ পথে চলাচলকারীদের।
লক্ষ্মীপুর থেকে ভোলা পর্যন্ত নৌপথের রহমতখালী চ্যানেল, কাটাখালী, মতিরহাট, বিরিবির, লালবয়াসহ আটটি স্থানে রয়েছে ডুবোচর। এসব এলাকায় যাত্রীবাহী লঞ্চগুলোকে বাঁশ ফেলে পানির উচ্চতা পরিমাপ করে যাতায়াত করতে হয়। ফলে ডুবোচর ঘুরে গন্তব্যে পৌঁছতে লাগছে কয়েক ঘণ্টা সময়। এ পথে চলাচল করা এমভি সঞ্চিতা-২-এর স্টাফ আবুল কালাম বণিক বার্তাকে জানান, মজুচৌধুরীরহাট থেকে ভোলার ইলিশা যেতে তাদের পাঁচ-ছয় জায়গায় বাঁশ দিয়ে পানির উচ্চতা পরিমাপ করতে হয়।
সম্প্রতি ভোলাগামী নুরজাহান, হারুনুর রশিদ, সিকান্দারসহ কয়েকজন যাত্রীর সঙ্গে কথা হয়। তারা জানান, প্রায়ই মাঝনদীতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আটকা পড়তে হয়। দীর্ঘদিন ধরে এ ভোগান্তিকে সঙ্গী করেই পথ চলতে হচ্ছে। বছরের পর বছর বিআইডব্লিউটিএর ড্রেজিং কাজ চলছে, কিন্তু হলেও কাজের কাজ কিছু হচ্ছে না। কর্তৃপক্ষ সঠিক তদারকির মাধ্যমে খননকাজ করলে হয়তো ভোগান্তি থেকে রক্ষা পাওয়া যেত।
মজুচৌধুরীরহাট থেকে রহমতখালী পর্যন্ত পাঁচ বছর ধরে ড্রেজিংয়ের কাজ করছে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)। প্রায় ৬০ কোটি টাকা ব্যয়ে এ কাজ চললেও এর তেমন সুফল মিলছে না। স্থানীয়রা বলছেন, পাঁচটি ড্রেজিং মেশিন কাজ করার কথা থাকলেও করেছে কেবল একটি।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, চিত্রা, বোরাক, শিবসা, গোমতিসহ পাঁচটি ড্রেজার মেশিন বসানো হলেও চারটিই অকেজো। প্রতিদিন সকাল ৬টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত ড্রেজিং করার কথা। অথচ ভাড়া করা একটি ড্রেজার দিয়ে লঞ্চঘাট এলাকায় ড্রেজিং চলে। তাও আবার নানা অজুহাতে দিনের অধিকাংশ সময় সেটি বন্ধ থাকে। আছে তেল-বালি বিক্রিসহ নানা অনিয়মের অভিযোগ।
তবে অভিযোগ অস্বীকার করে বিআইডব্লিউটিএর ড্রেজিং প্রকল্পে দায়িত্বরত উপসহকারী প্রকৌশলী হযরত হাসনাত নিপুণ জানান, বালি বিক্রির অভিযোগ সঠিক নয়। মূলত জোয়ারে নদী থেকে বিপুল পরিমাণ পলি ঘাট এলাকায় জমে যায়। কিন্তু পানি উন্নয়ন বোর্ডের স্লুইসগেট বন্ধ থাকায় বিপরীত দিক থেকে পানি নামার কোনো ব্যবস্থা না থাকায় বারবার ড্রেজিং করেও কোনো কাজ হচ্ছে না।
তিনি আরো জানান, বিআইডব্লিউটিসির প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে বড় নদীতে নাব্য দূরীকরণে সার্ভে করা হয়েছে। তিনটি রুটে ১০ কিলোমিটার ড্রেজিং করা প্রয়োজন। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা অনুযায়ী বড় তিনটি ড্রেজার বসিয়ে শিগগিরই কাজ শুরু করা হবে। তবে তাতেও কতটুকু সংকট নিরসন হবে তার সঠিক জবাব তার জানা নেই বলে জানান।
সংকট নিরসনে অবশ্য পানি উন্নয়ন বোর্ড, বিআইডব্লিউটিএসহ সম্মিলিতভাবে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার আশ্বাস দিয়েছে জেলা প্রশাসন। এ ব্যাপারে লক্ষ্মীপুর জেলা প্রশাসক রাজীব কুমার সরকার বলেন, ‘নাব্য সংকট দূরীকরণে পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলীর সঙ্গে বৈঠক করে ড্রেজিং প্রকল্পের জন্য একটি প্রস্তাব সংশ্লিষ্ট দপ্তরে পাঠানো হয়েছে। প্রকল্পের বরাদ্দ পেলে আশা করি শিগগিরই নদীতে ড্রেজিং শুরু করা হবে। এতে লক্ষ্মীপুর-ভোলা নৌ-রুটে লঞ্চ ও ফেরি চলাচলে ভোগান্তি দূর হবে।’