প্রদীপ কুমার রায়:
লক্ষ্মীপুর থেকে রায়পুরের বিস্তীর্ণ মাঠজুড়ে পাকা ধানের সোনালি ঝিলিক—দৃষ্টিনন্দন সেই দৃশ্য যেন বাংলার গ্রামীণ ঐতিহ্যের প্রতিচ্ছবি। এবার বোরো মৌসুমে আবহাওয়া অনুকূল ছিল, তাই ফলনও হয়েছে আশাতীত। কিন্তু মাঠ থেকে ঘরে ফসল উঠলেও, কৃষকের মুখে হাসি নেই। ন্যায্য মূল্য না পেয়ে হতাশ আর ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকেরা ভবিষ্যতের ধানচাষ নিয়ে চরম অনিশ্চয়তায় পড়েছেন।

উপজেলার দক্ষিণ চরআবাবিল, চরপাতা, উত্তর চরবংশীসহ বিভিন্ন ইউনিয়নে ঘুরে দেখা গেছে, ধানের ফলন নজরকাড়া হলেও বাজারে তার কোনো প্রতিফলন নেই। স্থানীয় হাটে বর্তমানে প্রতি মণ ধান বিক্রি হচ্ছে মাত্র ৮০০ থেকে ৮৫০ টাকায়, অথচ উৎপাদন খরচ পড়েছে মণপ্রতি ১,১০০ থেকে ১,২০০ টাকা। ফলে বিঘাপ্রতি ১৫ থেকে ১৬ হাজার টাকা খরচ করেও কৃষকেরা তুলতে পারছেন না মূলধন পর্যন্ত।
হতাশার সুরে দক্ষিণ চরআবাবিলের কৃষক আবদুর রশিদ বলেন, এই মৌসুমে ৩ বিঘা জমিতে ধান করেছি। ফলন ভালো হলেও বাজারে দাম শুনে মাথা ঘুরে গেল। প্রতি মণ ধানে প্রায় ৩০০ টাকার বেশি লোকসান। এখন কীভাবে সংসার চালাবো?”

চরপাতার কৃষক রমজান আলী ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, সরকার কাগজে কলমে যে দাম ঠিক করে, সেটা আমরা পাই না। সরকারি ক্রয়কেন্দ্র শুধু কাগজে আছে, বাস্তবে সাধারণ কৃষকরা ওখানে পৌঁছাতে পারে না। দালাল আর বড় ব্যবসায়ীরাই ওগুলো দখলে রেখেছে।
রায়পুরের রাখালিয়া, বামনী ও উপজেলা সদরের বাজার ঘুরে দেখা যায়, কিছু প্রভাবশালী ব্যবসায়ী কৃষকের কাছ থেকে ধান কিনে মজুত করছেন। পরে মিল মালিকদের কাছে সেই ধান দ্বিগুণ দামে বিক্রি করে তারা বিপুল মুনাফা করছেন। কৃষক ঠকছেন, লাভ পাচ্ছেন মধ্যস্বত্বভোগীরা।
উত্তর চরবংশীর কামাল হোসেন বলেন, ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ধান করেছি। জমি ভাড়া, সেচ, সার, কীটনাশক, শ্রমিক—সব খাতে প্রচুর খরচ হয়েছে। এখন যদি দাম না পাই, চলা দায় হয়ে যাবে।
আরেক কৃষক হারুন অর রশিদ বলেন, প্রতি বছর যদি লোকসান হয়, তাহলে আর চাষ করে লাভ কী? অনেকেই ভাবছে, এবারই শেষ ধানচাষ। সামনে বিকল্প কিছু ভাবতেই হবে।
রায়পুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মাজেদুল ইসলাম বলেন, সরকার নির্ধারিত দামে (প্রতি মণ ১,৪৪০ টাকা) কৃষকদের কাছ থেকে ধান কেনা হচ্ছে। মাঠপর্যায়ে মনিটরিং বাড়ানো হয়েছে এবং সিন্ডিকেট রোধে পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।
তবে কৃষক নেতারা মনে করেন, কেবল ঘোষণায় সমস্যা মিটবে না। প্রকৃত কৃষকদের তালিকা অনুযায়ী সরাসরি তাদের কাছ থেকে ধান ক্রয়ের কার্যকর ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। তা না হলে কৃষকরা দিন দিন কৃষিকাজ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবেন।
স্থানীয় সচেতন নাগরিক মো. সুমনের মন্তব্য, সিন্ডিকেট এখন ওপেন সিক্রেট। কৃষক যে দামে ধান বিক্রি করে, তা পরে দ্বিগুণ দামে বিক্রি হয়। লাভ পায় মধ্যস্বত্বভোগী, কষ্ট পায় উৎপাদক।
রায়পুরের মাঠে এখনো ধান শুকানো হচ্ছে, বাতাসে ভাসছে ধানের মিষ্টি গন্ধ। কিন্তু সেই সুবাস আর আনন্দ বয়ে আনছে না। বরং ভর করেছে চরম উদ্বেগ আর ক্ষোভ। যদি সরকার মাঠপর্যায়ে বাস্তব পদক্ষেপ না নেয়, তাহলে এই কৃষিপ্রধান সমাজ এক ভয়াবহ দিকেই ধাবিত হবে।
কৃষির ভবিষ্যৎ বাঁচাতে হলে এখনই কৃষকের পাশে দাঁড়াতে হবে। নইলে ‘ধানভরা গোলা’ কেবল স্মৃতির অংশ হয়ে থাকবে—চাষির ঘরে থাকবে না সোনার ধান, থাকবে শুধু বোঝা আর বেদনা।