প্রদীপ কুমার রায়:
লক্ষ্মীপুর জেলার নাম উচ্চারিত হলেই প্রথমেই যে কৃষিপণ্যটির কথা মনে পড়ে, তা হলো সুপারি। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এই অঞ্চলের মানুষ সুপারি চাষ করে আসছে। শুধু কৃষিপণ্য নয়, এটি লক্ষ্মীপুরের সংস্কৃতি, সামাজিক পরিচয় এবং জীবনধারার অংশ। কোনো বিবাহ, কোনো ধর্মীয় বা সামাজিক অনুষ্ঠানে সুপারির অনুপস্থিতি যেন অপূর্ণতার প্রতিচ্ছবি।
স্থানীয় প্রবীণ কৃষক মতলুব আলী বলেন, “আমার দাদার আমলেও এই গাছ ছিল, আমিও রেখে গেলাম আমার নাতির জন্য। এটা শুধু গাছ নয়, আমাদের ঐতিহ্য।”
লক্ষ্মীপুর জেলার রায়পুর, রামগঞ্জ ও কমলনগর উপজেলায় সুপারি চাষ সর্বাধিক। সাধারণত আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে বীজ রোপণ করা হয়, এবং গাছ থেকে ফল সংগ্রহ করা যায় প্রায় ৭ থেকে ৮ বছর পর। গাছ একবার ফল দিতে শুরু করলে প্রায় ৩০ থেকে ৪০ বছর পর্যন্ত ফলন দেয়। প্রতি একর জমিতে ১৫০-২০০টি সুপারি গাছ রোপণ করা যায়। গড়ে প্রতি গাছ থেকে বছরে ১০০০-১৫০০টি সুপারি পাওয়া যায়। এ হিসেব অনুযায়ী, একটি একর জমি থেকেই বছরে লক্ষাধিক টাকার সুপারি বিক্রি করা সম্ভব।
চাষিদের ভাষ্য অনুযায়ী, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব থাকলেও লক্ষ্মীপুরের মাটি ও আবহাওয়া এখনও সুপারি চাষের জন্য উপযোগী। জৈব সার ও পরিবেশবান্ধব পরিচর্যার মাধ্যমে উৎপাদন আরও বৃদ্ধি পেয়েছে।
সুপারি গাছ রোপণের পর শুরু হয় যত্নের দীর্ঘ অধ্যায়। নিয়মিত আগাছা পরিষ্কার, গাছের গোড়ায় সার দেওয়া, পোকামাকড় নিয়ন্ত্রণ, এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষা করা এই পরিচর্যার অংশ।
সুপারি সংগ্রহের সময় শ্রমিকদের অত্যন্ত সাবধানে গাছে উঠতে হয়। একেকটি সুপারি নামাতে গিয়ে জীবন ঝুঁকির কথাও শোনা যায়। এ ছাড়া, সংগ্রহের পর শুরু হয় ধোয়া, স্লাইস করা, রোদে শুকানো, এবং বাজারজাত করার জটিল প্রক্রিয়া।
রায়পুরের এক উদ্যোক্তা আবুল কাশেম খোকা বলেন, আমি নিজে সুপারির খোল দিয়ে বিভিন্ন আসবাবপত্র বানিয়ে তা বাজারজাত করি। আগে শুধু পুরুষরাই কাজ করত, এখন নারীরাও এই শিল্পে যুক্ত হচ্ছে।
বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বাজারে লক্ষ্মীপুরের সুপারির চাহিদা ব্যাপক। ঢাকাসহ দেশের বড় শহরগুলোতে লক্ষ্মীপুরের সুপারিই সবচেয়ে বেশি সরবরাহ হয়। প্রতি কেজি সুপারি বিক্রি হয় ২৫০-৩০০ টাকা দরে, আর প্রক্রিয়াজাতকৃত পণ্য বিক্রি হয় আরও বেশি দামে।
একই সঙ্গে ভারতের ত্রিপুরা, আসাম এবং মধ্যপ্রদেশেও লক্ষ্মীপুরের শুকনো সুপারি চোরাপথে প্রবেশ করে বলে জানিয়েছেন কয়েকজন ব্যবসায়ী। সরকারিভাবে রপ্তানির সুযোগ তৈরি হলে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের দারুণ সম্ভাবনা রয়েছে।
স্থানীয় কৃষি বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, লক্ষ্মীপুর জেলায় প্রতি বছর প্রায় ৩৫০ কোটি টাকার সুপারি বাণিজ্য হয়, যার মধ্যে ৪০ শতাংশই আসে রপ্তানিযোগ্য প্রক্রিয়াজাত সুপারি থেকে।
সুপারি শিল্প শুধু কৃষক নয়, নারীদের জন্যও সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। লক্ষ্মীপুর ও রায়পুরে গড়ে উঠেছে ছোট ছোট ঘরোয়া কারখানা, যেখানে নারীরা সুপারি কেটে, শুকিয়ে এবং বস্তায় ভরে বাজারজাত করছেন।
উন্নয়ন সংস্থা ‘প্রগতি নারী সংগঠন’ এর সভাপতি শিরিন আক্তার বলেন, প্রতি বছর আমাদের সংগঠনের মাধ্যমে অন্তত ৫০০ নারী সরাসরি সুপারি প্রক্রিয়াজাতকরণ ও বিক্রির সঙ্গে যুক্ত হন। এই শিল্প স্থানীয় পর্যায়ে নারীর ক্ষমতায়ন, ঘরোয়া আয় বৃদ্ধি এবং আত্মনির্ভরশীলতার সুযোগ তৈরি করছে।
যদিও এই শিল্পে অনেক সম্ভাবনা রয়েছে, তবে চ্যালেঞ্জও কম নয়। ভালো মানের বীজের সংকট, আধুনিক প্রশিক্ষণ ও কারিগরি সহায়তার অভাব, প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য এই খাতের অগ্রযাত্রায় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা, কৃষি লোন, প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন এবং সরাসরি রপ্তানির সুযোগ তৈরির মধ্য দিয়ে লক্ষ্মীপুরের সুপারি শিল্প জাতীয় অর্থনীতির বড় চালিকাশক্তি হতে পারে।
লক্ষ্মীপুরের সুপারি শুধু একটি পণ্য নয়, এটি এক ইতিহাস, এক সম্ভাবনার নাম। এই শিল্পের পেছনে আছে হাজারো কৃষকের ঘাম, নারী উদ্যোক্তার সাহস, এবং একটি অঞ্চলের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। যদি সঠিক পরিকল্পনা, সহায়তা এবং নীতি গ্রহণ করা যায়, তবে এই ‘সবুজ সোনা’ হয়ে উঠতে পারে জাতীয় অর্থনীতির অনন্য সম্পদ।