পারভেজের মা ফাতেমা বেগম বলেন, অভাবের সংসার। আমার ছেলে সেই ছোটবেলা থেকে সংসারের হাল ধরেছে। তার পাঠানো টাকা দিয়ে চলতো সংসার। এখনতো আর ছেলেটি নেই, সংসারের হাল ধরার মতো কেউই রইলো না।
জানা গেছে, বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের সময় ৪ আগস্ট রাজধানীর মিরপুর ১০ নাম্বারে আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের সামনে পারভেজের মাথায় গুলি লাগে। এরপর ১ মাস ৮ দিন চিকিৎসাধীন থেকে ১২ সেপ্টেম্বর সকালে রাজধানীর ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরো সায়েন্সেস হাসপাতালের ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে (আইসিইউ) তিনি মারা যান। তিনি মিরপুর ১০ নাম্বারে সেনপাড়া থাই গ্লাসের দোকানে কাজ করতেন।
ঘটনার একদিন আগে পারভেজের সঙ্গে কথা হয় তার মা ফাতেমা বেগমের সঙ্গে। ছেলে ফোনে তার মাকে বলে ‘মা আমি বাঁচবো না, না খেয়েই মারা যাবো।' প্রতিত্তোরে তার মা বলেন, 'বাবা তুই বাড়ি চলে আয়। মা যদি এক মুঠো খেতে পারি, তুইও পারবি। ছেলেটি না খেয়ে মারা না গেলেও, গুলি খেয়ে ঠিকি মারা গেল।'
জীবনের সাথে যুদ্ধ করেও বাঁচতে পারলো না। সেই ছোট বেলা থেকেই যে তার পরিবারকে বটগাছের মতো ছায়া দিয়ে আগলে রেখেছিল। পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে সবাইকে ছেড়ে পরপারে পাড়ি জমিয়েছে পারভেজ।
পারভেজের মা ফাতেমা বেগম বলেন, ঢাকার মিরপুর ১০ নাম্বারে স্ত্রী রুপা আক্তারকে নিয়ে পারভেজ ভাড়া বাসায় থাকতো। আন্দোলনের সময় দোকান বন্ধ ছিল। তার বাসায়ও পর্যাপ্ত খাবার ছিল না। এজন্য আমাকে বলেছে মা ঘরে চাল নেই, না খেয়েই মারা যাবো মনে হচ্ছে। আমি চলে আসতে বলেছি, কিন্তু সে আর আসেনি। তার মৃতদেহ এসেছে বাড়িতে। পারভেজের স্ত্রী তার বাবার বাড়ি পাবনায় চলে গেছে।
তিনি আরও বলেন, ঘটনার দিন এক ডাক্তার ফোন দিয়ে বলছে মোবাইলের মালিক কে হয় আমার? আমি বলেছি আমার ছেলে হয়। বলেছে নাম কি, বললাম পারভেজ। তখন বলেছে আপনার ছেলে গুলিবিদ্ধ হয়েছে, তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। পরে হাসপাতালে গিয়ে দেখি, আমার ছেলে কথা বলতে পারে না। প্রথম থেকেই একই অবস্থা, মাঝেমধ্যে হাতের ইশারা দিয়ে কিছু বুঝানোর চেষ্টা করতো, কিন্তু কিছুই বুঝতাম না।
তিনি বলেন, পারভেজ ছোট বেলা থেকেই সংসার খরচ দিতো। ছেলেটি পড়ালেখা বেশি করতে পারেনি। শিশুকাল কেটেছিল নানার বাড়িতে। চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত পড়ার সুযোগ পেয়েছে। কিন্তু আমাদের অভাব অনটনের কারণে ১২ বছর বয়সেই সে ঢাকাতে কাজের সন্ধানে যায়। সেখানে থাই গ্লাসের দোকানে কাজ শুরু করে। তার বোনদের পড়ালেখার খরচও বহন করতো সে। আজতো সেই নেই। আগেতো সংসার খরচ পারভেজ চালাইতো। সামনে চালাবে কে? তার বাবার সামর্থ্য নেই কোন কাজ করার। তিনি মানসিকভাবে অসুস্থ।
ঢাকায় হাসপাতালে পারভেজকে দেখতে যায় তার বোন নাহিদা আক্তার। কিন্তু শেষ বারের জন্যও ভাইয়ের সঙ্গে একটি শব্দও কথা বলতে পারেনি। উল্টো তার দাবি ভাই তার সঙ্গে রাগ করেই চলে গেছে না ফেরার দেশে। তিনি বলেন, আমি হাসপাতালে গিয়েছি। ভাইকে আইসিউতে রাখা হয়েছিল। সেখানে থাকা লোকজনকে পরিচয় দিলে তারা আমাকে ভাইয়ের কাছে যেতে দেয়। ভাই প্রথমে চোখ বন্ধ করে রেখেছিল। পরে চোখ খুলে আমাকে দেখতে পেয়ে হাতে লাগানো স্যালাইনসহ বিভিন্ন ডাক্তারি সরঞ্জাম খুলতে ইশারা করে। খুলে না দেওয়ায় একপর্যায়ে ভাই আমার ওপর রাগ হয়ে গেছে। পরে হাসপাতালের লোকজন আমাকে আইসিইউ থেকে বের হয়ে যেতে বলে।
ভাইয়ের কথা মনে পড়ার বিষয়ে জানতে চাইলে দুই চোখে পানি চলে আসে নাহিদার। এরপর আর কোন কথা বেরোয়নি মুখ থেকে।
মানসিক সমস্যা পারভেজের বাবা নবী উল্যা বলেন, হঠাৎ দুনিয়া ছেড়ে চলে গেছে। ছেলেটার জন্য মন টানে। কুরবানির ঈদের সময়ও বাড়িতে আসেনি। বাড়িতে থাকলেতো আর ছেলেটা এভাবে মারা যেতো না।
পারভেজের চাচাতো ভাই আরাফাত হোসেন বলেন, পারভেজই পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন। আমার বিকাশ নাম্বারের বাড়ির জন্য সবসময় টাকা পাঠাতো। বাড়িতে আসলে আমার সঙ্গেই সবচেয়ে বেশি সময় কাটাতো।
পারভেজের প্রতিবেশী সাইফুল ইসলাম বলেন, পারভেজেই সংসারের খরচ চালাতো। তার বাবা মানসিকভাবে অসুস্থ। প্রায়ই ঘরে ভাঙচুরসহ বিভিন্ন সমস্যা সৃষ্টি করে। এলাকার মানুষ তাদেরকে পর্যাপ্ত সহায়তা করে। পারভেজের এক বোনকে এলাকার সবাই উদ্যোগ নিয়ে বিয়ে দিয়েছে। এখনো তার একটি বোন অবিবাহিত রয়েছে। এছাড়া ছোট দুটি শিশু রয়েছে। তাদের সংসারে হাল ধরার কেউ নেই। এখন অনেকেই তাদের সাহায্য করেছে। কিন্তু পরবর্তীতে তাদের সংসার চালানোর মতো কেউ নেই।
তিনি আরও বলেন, ১৩ সেপ্টেম্বর স্থানীয় কামারহাট ঈদগাঁহ মাঠে পারভেজের জানাযা অনুষ্ঠিত হয়। তাদের পারিবারিক কবরস্থান বন্যার পানিতে ডুবে ছিল। এতে পাশ্ববর্তী আরেক জায়গায় তার মরদেহ দাফন করা হয়েছে।