কিন্তু মাসরুর তার সহধর্মিনীকে বলতেন, ‘আমি আন্দোলনে গেলে ‘শহীদ’ হবো। আমার সন্তানকে আমি আন্দোলনে নিয়ে যাবো। আমার সন্তানকে সামনে রাখবো, আমি পেছনে থাকবো। আমি যদি মারা যায়, তখন তোমাদেরকে সবাই শহীদের স্ত্রী-সন্তান ডাকবে। আর আমার সন্তান মারা গেলে, তখন সবাই আমাদেরকে শহীদের বাবা-মা ডাকবে’। নবাগত শিশুকে কোলে নিয়ে কান্না জড়িত কণ্ঠে সালমা এসব কথা জানান।
এদিকে মাসরুর যখন গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায় তখন তার স্ত্রী বিবি সালমা ৮ মাসের অন্ত্বসত্ত্বা ছিলেন। তার মৃত্যুর ঠিক দেড় মাস পর গত রোববার (২২ সেপ্টেম্বর) তার স্ত্রীর কোলজুড়ে ফুটফুটে ছেলে সন্তান জন্ম নিয়েছে। এখনো তার নাম রাখা হয়নি।
তার সাড়ে ৩ বছর বয়সী নাফিজা আক্তার নামে এক কন্যা সন্তান রয়েছে। যে প্রতিদিন তার বাবার সঙ্গে মোবাইলফোনে কথা বলতো। গত দেড় মাস ধরে নাফিজার সঙ্গে তার বাবার কথা হয় না। বাবার কথা জিজ্ঞেস করতেই তার দুই চোখ পানিতে ভিজে যায়। ছোট্ট নাফিজা বাবা হারার বেদনা কি? হয়তো তাও বুঝতে পারছে না। তবে বাড়িতে সবার উপস্থিতে তার দুই চোখ শুধু তার বাবাকে খোঁজে। কোন একদিন হয়তো তার বাবা এসে তাকে কোলে ট আশায় ছোট্ট নাফিজা।
শিশু সন্তানদের নিয়ে সালমা এখন তার বাবার বাড়ি কমলনগর উপজেলার চরফলকন ইউনিয়নের ফলকন গ্রামে আছেন। বাবাহীন তার দুই সন্তানের ভবিষ্যৎ এখন কালো মেঘে ঢাকা।
নিহত মাসরুর স্ত্রী সালমা বলেন, আমার স্বামী আমাকে বলেছিল আন্দোলনে তার সঙ্গী হতে। আমাকে আন্দোলনে যেতে বুঝিয়ে গেছে। কমলনগরের হাজিরহাট বাজারে মিছিল হবে, আমাকে যেতে বলেছে। তবে সঙ্গে আমার সন্তানকে নেওয়ার জন্যও বলেছিল। এখন সবাই আছে, শুধু তিনি নেই। কিন্তু সামনে দিকে আমাদের পরিস্থিতি পুরো অন্ধকার। এখন যেমন তেমনভাবে আছি। আল্লাহপাক জানেন, কি অবস্থায় আমি ছেলেমেয়েকে নিয়ে থাকবো।
ঘটনার দিনই স্ত্রী সালমার সঙ্গে মাসরুরের কথা হয়। তখন মাসরুর দোকানে ছিলেন। সালমাকে তিনি জানিয়েছেন, তিনি আন্দোলনে যাবেন। সালমা খাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আগে আন্দোলনে যাবো, তারপর খাওয়া-ধাওয়া করবো। পরে সালমা তার ভাইয়ের কাছে জানতে পারেন মাসরুর মারা গেছেন।
মাসরুর ৫ আগস্ট গাজীপুরে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনকারীদের সঙ্গে স্বৈরাচারী সরকারের পতনের আন্দোলনে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। তিনি লক্ষ্মীপুরের কমলনগর উপজেলার পাটওয়ারীর হাট ইউনিয়নের চরবড়ালিয়া গ্রামের এলাকার বৃদ্ধ আবদুল খালেকের ছেলে। কর্মজীবনের শুরুতে তিনি মাদরাসায় শিক্ষকতা করতেন। পরে পল্ট্রি খামার ও ইলেক্ট্রিক সরঞ্জামের ব্যবসাও করেছেন। তবে কোথাও স্থায়ী হতে পারেননি। সবশেষ প্রায় ৭ মাস আগে গাজীপুরে তার শ্বশুর মো. মোস্তফার কাছে যান ব্যবসার করার উদ্দেশ্যে। সেখানে ব্যবসায় ভালোই করছিলেন। কিন্তু ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের রাজনীতি করায় স্বৈরাচারী সরকার পতনের আন্দোলনে সবসময় সক্রিয় ছিলেন তিনি। মাসরুল ইসলামী আন্দোলনের পাটওয়ারীর হাট ইউনিয়ন শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন।
মাসরুরের শিক্ষকতা জীবনের সহকর্মী সিরাজুল ইসলাম মেহরাজ বলেন, ঘটনার দিন মাসরুর তার এক বন্ধুকে বলেছিল- গুলিবিদ্ধ কেউ একজনকে তিনি হাসপাতাল নিয়ে যাচ্ছেন। বলেছিলেন গুলিবিদ্ধ লোকটি তার বন্ধু ছিল। এরপর আর তার সঙ্গে কোন কথা হয়নি। পরে গাজীপুরের শহীদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে তার মরদেহ পাওয়া যায়। ধারণা করা হচ্ছে- গুলিবিদ্ধ অবস্থায় তাকেই হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। পরিবার বা আত্মীয়-স্বজনদের দুঃশ্চিন্তায় না ফেলতে তিনি ঘটনাটি লুকিয়েছেন।
মাসরুরের ছোট ভাই হুমায়ুন কবির বলেন, আমার ভাই জীবনে অনেক কষ্ট করেছে। নিজে পড়ালেখা করেছে। পাশাপাশি আমাদের জন্য কষ্ট করেছেন। তিনি একটি মাদরাসা করেছেন। পরে ওই মাদরাসার দায়িত্ব আমাকে বুঝিয়ে দিয়ে তিনি গাজীপুরে ব্যবসা করতে যান। আমার ভাই গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছেন। তার পেটে ও পিঠে দুটি গুলির চিহ্ন দেখা গেছে।
মাসরুরের চাচা শ্বশুর ওমর ফারুক বলেন, মাসরুর আর্থিকভাবে তেমন একটা স্বাবলম্বী ছিল না। গাজীপুর যাওয়ার আগে তার অন্ত্বসত্ত্বা স্ত্রীকে শ্বশুর বাড়িতে রেখে যায়। এখনতো কোনভাবে দিন কাটছে তাদের। সামনে তারা কিভাবে চলবে, যতই সময় যাচ্ছে- তা নিয়ে দুঃশ্চিন্তা বাড়ছে। সরকার যদি পরিবারটির দিকে মুখ তুলে তাকায়, হয়তো মাসুরের স্ত্রী সালমা ছেলেমেয়েকে নিয়ে স্বাভাবিকভাবে জীবন যাপন করতে পারবে।
মাসরুরের কথা জিজ্ঞেস করতেই তার বৃদ্ধ বাবা আবদুল খালেক কান্নায় ভেঙে পড়েন। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, মাসরুর সবার চেয়ে ভালো ছিল। পরিবারের সবার দেখভাল করতো। আন্দোলনে গিয়ে সে মারা গেছে। সে শহীদ হয়েছে।